আরবি মাসের নাম একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে গিয়ে আমরা ইসলামী ক্যালেন্ডারের মাস ভুলে যাই। বিভিন্ন সময় চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে এই হিজরি ক্যালেন্ডার।আজকে আমরা হিজরি ক্যালেন্ডারে আরবি মাসের নাম||আরবি ১২ মাসের নাম সম্পর্কে জানবো।
আরবি ১২ মাসের নাম
- মুহররম (محرم)
- সফর (صفر)
- রবিউল আউয়াল (ربيع الأول)
- রবিউস সানি (ربيع الثاني)
- জমাদিউল আউয়াল (جمادى الأولى)
- জমাদিউস সানি (جمادى الثانية)
- রজব (رجب)
- শাবান (شعبان)
- রমজান (رمضان)
- শাওয়াল (شوال)
- জিলকদ (ذو القعدة)
- জিলহজ্জ (ذو الحجة)
আরবি ১২ মাসের গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত
মুহররম (محرم)
মুহাররম মাসটি হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস কারণ এই মাসের ১০ তারিখে আশুরা পালন করা হয়। এটি কারবালা দিবস নামেও পরিচিত। এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সফর (صفر)
সফর এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস। এটি একটি স্বাভাবিক মাস কোনো বিশেষ ফজিলত নেই মাসে । সবকিছুই স্বাভাবিক।
রবিউল আউয়াল (ربيع الأول)
রবিউল আউয়াল মাস হিজরি ক্যালেন্ডারের তৃতীয়তম মাস। এটি আমাদের শেষ নবি হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জন্মের মাস। ১২ ই রবিউল আউয়াল আমাদের শেষ নবির জন্মদিন। এই দিনটিকে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বলে। মুসলিম উম্মাহ এই দিনকে মওলিদ উন-নবী হিসেবে উদযাপন করে থাকে।
রবিউস সানি (ربيع الثاني)
রবিউস সানি এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের চতুর্থ মাস। এটি একটি স্বাভাবিক মাস কোনো বিশেষ ফজিলত নেই মাসে । সবকিছুই স্বাভাবিক।
জমাদিউল আউয়াল (جمادى الأولى)
জমাদিউল আউয়াল এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস। এটি একটি স্বাভাবিক মাস কোনো বিশেষ ফজিলত নেই মাসে । সবকিছুই স্বাভাবিক।
জমাদিউস সানি (جمادى الثانية)
জমাদিউস সানি ইসলামী চান্দ্র পঞ্জিকার ষষ্ঠ মাস।এই মাসে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কন্যা ফাতিমা (রাঃ) ইন্তেকাল করেছিলেন। তাছাড়া মুয়াতাহের যুদ্ধে বিজয় লাভ হয়েছিলো এই মাসে।
রজব (رجب)
রজব ইসলামী চান্দ্র পঞ্জিকার সপ্তম মাস। এই মাসের ২৭ তারিখে মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এই রাতে তিনি মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। এই ঘটনাটি রজব মাসের ২৭তম রাতে ঘটেছে বলে বিশ্বাস করা হয়, যা “শবে মেরাজ” নামে পরিচিত।
শাবান (شعبان)
শাবান ইসলামী চান্দ্র পঞ্জিকার অষ্টমতম মাস।শাবান মাসের ১৫তম রাতে পালিত হয় “লাইলাতুল বরাত” বা “শবে বরাত”। মুসলমানরা এই রাতে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া, ইবাদত এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। অনেকের বিশ্বাস, এই রাতে আল্লাহ তাআলা পরবর্তী বছরের জন্য মানুষের তাকদির নির্ধারণ করেন। তাছাড়া এই মাসে কিবলা পরবির্তন হয়ে থাকে ।প্রথমদিকে মুসলমানরা নামাজে বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) মুখী হয়ে নামাজ পড়তেন, কিন্তু শাবান মাসে আল্লাহর আদেশে কিবলা পরিবর্তন করে কাবা শরীফের দিকে নামাজ পড়া শুরু হয়।
রমজান (رمضان)
রমজান ইসলামিক চান্দ্র বছরের নবম মাস এবং এটি মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজান মাসে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ইবাদত সংঘটিত হয়-
রোজা (সিয়াম): রমজান মাসে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখা বাধ্যতামূলক (ফরজ)। রোজা রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও সংযম অনুশীলন করেন এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। রোজা শুধু খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার নাম নয়; বরং এটিকে সমস্ত খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার এবং আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবেও দেখা হয়।
লাইলাতুল কদর (শবে কদর): রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোন এক রাতে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর পালিত হয়। এটি এমন একটি রাত, যা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। কুরআন মাজিদে উল্লেখ আছে যে, এই রাতে ফেরেশতারা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং বিশেষ রহমত ও বরকত নিয়ে আসেন।
কুরআন নাজিল: রমজান মাসে কুরআন মাজিদ নাজিল শুরু হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এই মাসে কুরআনকে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে পাঠান। তাই এই মাসে কুরআন তিলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
তারাবিহ নামাজ: রমজান মাসে প্রতি রাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়। এটি সুন্নত নামাজ, যা এশার নামাজের পর আদায় করা হয়। মুসলমানরা এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে বরকত ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ইফতার ও সেহরি: রোজা রাখার সময়, সুবহে সাদিকের আগে খাবার গ্রহণ করা হয়, যা সেহরি নামে পরিচিত। সূর্যাস্তের পর রোজা ভাঙা হয়, যা ইফতার নামে পরিচিত। ইফতার ও সেহরি মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে।
ইতেকাফ: রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতেকাফ করা হয়, যেখানে মুসলমানরা ইবাদতে মগ্ন থেকে আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষভাবে রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ঈদুল ফিতর: রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতর পালিত হয়, যা মুসলমানদের জন্য আনন্দের দিন। এই দিনে রোজা ভাঙা হয় এবং আল্লাহর নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ঈদুল ফিতরের আগে ফিতরা (সাদকাতুল ফিতর) প্রদান করা বাধ্যতামূলক, যা গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
আরো জানুন;
তালাকের ইসলামী বিধান কি জেনে নিন।
Psychology (মনোবিজ্ঞান) নিয়ে অনার্স করা কেমন সিদ্ধান্ত : সাবজেক্ট রিভিউ
শাওয়াল (شوال)
শাওয়াল ইসলামী চান্দ্র বছরের দশম মাস এবং রমজান মাসের পরবর্তী মাস। শাওয়াল মাস, ঈদুল ফিতরের আনন্দের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে ছয় রোজা পালন করা হয়ে থাকে যা সারাবছর রোজা পালন করার সমান ফজিলতপূণ। শাওয়াল মাসে নবী করিম (সাঃ) এর সাথে আয়েশা (রাঃ) এর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়া উহুদের যুদ্ধ এই মাসেই সংঘটিত হয়েছিলো।
জিলকদ (ذو القعدة)
জিলকদ ইসলামী চান্দ্র বছরের একাদশ মাস এবং চারটি পবিত্র মাসের একটি। এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।ইসলামের ইতিহাসে জিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি হয়েছিলো। এই মাসে হজ্জের প্রস্তুতি শুরু করতে হয়।
জিলহজ্জ (ذو الحجة)
জিলহজ্জ ইসলামিক চান্দ্র বছরের দ্বাদশ এবং শেষ মাস। যা মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ।জিলহজ্জ মাস মুসলমানদের জন্য ইবাদত, ত্যাগ, এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। এ মাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় –
হজ্জ: জিলহজ্জ মাসের ৮ম থেকে ১২তম তারিখ পর্যন্ত হজ্জ পালিত হয়, যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। হজ্জ হলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুসলমানদের জন্য পবিত্র কাবা শরীফে সমবেত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি একজন মুসলিমের জীবনে কমপক্ষে একবার অবশ্যই পালনীয় (যদি সক্ষম হয়)। হজ্জের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা, কাবার তাওয়াফ, এবং শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা অন্তর্ভুক্ত।
ইদুল আযহা (কুরবানির ঈদ): জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা পালিত হয়, যা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান উৎসব। এই দিনে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করেন, যা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ত্যাগের প্রতীক। কুরবানি করা পশুর গোশত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
আরাফাতের দিন: জিলহজ্জ মাসের ৯ম দিনকে আরাফাতের দিন বলা হয়, যা হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। হজ্জ পালনকারীরা এই দিনে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দোয়া করেন। এটি এমন একটি দিন যেখানে মুসলমানরা রোজা রাখেন এবং আল্লাহর নিকট থেকে প্রচুর সওয়াব অর্জনের আশা করেন। হাদিসে বলা হয়েছে যে, আরাফাতের দিনের রোজা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের পাপসমূহের জন্য ক্ষমা লাভের মাধ্যম হয়।
তাকবির: জিলহজ্জ মাসের ৯ম থেকে ১৩তম দিন পর্যন্ত “তাকবিরে তাশরিক” বলা হয়, যেখানে মুসলমানরা নামাজের পর তাকবির পড়েন। এটি আল্লাহর মহিমা ও গৌরব বর্ধনের একটি বিশেষ সুযোগ।
তাশরিকের দিনগুলো: জিলহজ্জের ১১, ১২ এবং ১৩ তারিখে তাশরিকের দিন পালিত হয়, যা হজ্জের কার্যক্রমের অংশ। এই দিনগুলোতে মিনায় অবস্থান করে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং ইবাদত-বন্দেগি করা হয়।
আরবি মাসগুলোর ইতিহাস গুরুত্ব এবং পটভূমি অত্যন্ত ব্যাপক আমি সামান্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। ধন্যবাদ মনোযোগ সহকারে পোস্টটি পড়ার জন্য।